Botogram Madrasha

জামিয়া ইসলামিয়া হামিদিয়া কাওমিয়া বটগ্রাম এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

ঐশি শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড ও জাতির উন্নতির সোপান। সুস্থ, সঠিক ও নির্ভুল শিক্ষা সুশীল সমাজ বিনির্মাণের চাবিকাঠি। আর এ শিক্ষাই সুন্দর সমাজ গড়ার পূর্বশর্ত ও সকল প্রকার অসভ্যতা দূর করার হাতিয়ার। মানব রচিত কোনো ব্যবস্থা নয়, বরং একমাত্র খোদা প্রদত্ত কুরআন সুন্নাহর তা’লিম-ই মানুষের জাগতিক ও পরকালীন সফলতা আনতে পারে। বৃটিশ প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিষফল হতে উপমহাদেশের সরলপ্রাণ মুসলমানদের ঈমান-আকিদা ও তাহযিব-তামাদ্দুনকে হেফাজত করতে, ইসলামি শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বখ্যাত ইসলামি বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দ। মূলত দারুল উলুম দেওবন্দ ছিল ইসলাম ও স্বাধীনতা রক্ষা আন্দোলনে উৎসর্গিতপ্রাণ এক প্রতিষ্ঠান। তৎকালীন উপমহাদেশের দূরদর্শী উলামায়ে কিরামের আজন্ম লালিত চেতনার প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ন।

তৎকালীন বৃটিশ উপনিবেশ, এই উপমহাদেশে ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আদর্শিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক গোলামির শৃঙ্খল থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করাই ছিল দারুল উলুম দেওবন্দের মূল চেতনা। পর্যায়ক্রমে গোটা উপমহাদেশে গড়ে ওঠে এ ধারার অসংখ্য মাদরাসা। আমাদের দেশে প্রচলিত মাদারিসে কওমিয়া তারই বাস্তব নমুনা। জামিয়া ইসলামিয়া হামিদিয়া বটগ্রামও বিশ্বখ্যাত ইসলামি বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের আলোকে যুগোপযোগী শিক্ষা কারিকুলামে পরিচালিত একটি শীর্ষস্থানীয় প্রাচীনতম বৃহত্তর ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ।

এক নজরে জামিয়া হামিদিয়া বটগ্রাম

অবস্থান- কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ থানাধীন বটগ্রাম এলাকায় স্মৃতি বিজোরিত বিশাল দেহ পল্লবী নিয়ে দন্ডায়মান জামিয়া ইসলামিয়া হামিদিয়া আহলিয়া বটগ্রাম। হাকিমুল উম্মত হযরত থানভী রহ.-এর আধ্যাত্মিক দিক্ষায় ধন্য এবং শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী রহ.-এর হাতে গড়া স্বৰ্ণ মানব কুতুবুল আলম, আরেফ বিল্লাহ আল্লামা আব্দুল হামীদ রহ. আপন শায়খ হাকিমুল উম্মাত থানভী রহ.-এর নির্দেশে, নিজ মুবারক স্বপ্ন মোতাবেক নিজস্ব ভূমিতে ১৯০৮ খৃষ্টাব্দে এ জামিয়ার ভিত্তি স্থাপন করেন।

আদর্শ-

জামিয়া ইসলামিয়া হামিদিয়া আহলিয়া বটগ্রাম বিশ্ববিখ্যাত মাদারে ইলমি-দারুল উলুম দেওবন্দের সিলসিলাভুক্ত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শভিত্তিক বৃহত্তর দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-

১. ইলমে দীনের হেফাজত ও ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে আহকামে খোদাওয়ান্দি ও সুন্নাতে নববী প্রতিষ্ঠার লক্ষে নিয়মতান্ত্রিক তালিম ও তারবিয়াতের মাধ্যমে, হক্কানি আলেম তৈরি করত: তাদেরকে বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে, দেশ ও জাতির খেদমতের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।

২. আকায়েদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ও ফিকহে হানাফির সংরক্ষণ এবং দেওবন্দি সিলসিলায় তালিম তারবিয়াতের যথাযথ বাস্তবায়ন করা।

৩. ইসলাম বিদ্বেষী খোদাদ্রোহীদের নিয়মতান্ত্রিক মোকাবেলাপূর্বক সমাজ থেকে নাস্তিক্যবাদ ও শিরক বিদআতের মূলোৎপাটনের মাধ্যমে জিহাদি তৎপরতা দ্বারা সমাজে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা ও সর্বস্তরে ইসলামি সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন করা ।

জামিয়ার শিক্ষাধারা-

জামিয়া হামিদিয়া গতানুগতিক কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম নয়। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে জামিয়া সাজিয়েছে তার পাঠদান পদ্ধতি। শিশুশ্রেণি থেকে শুরু করে দীনি শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদীস (মাষ্টার্স) পর্যন্ত শ্রেণিভিত্তিক পাঠের ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি ইলমে মানতেক, আরবী ও বংলা সাহিত্যসহ নানামুখী পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন করে বহুমুখী যোগ্যতা সম্পন্ন বিচক্ষণ আলেমেদীন জাতিকে উপহার দেওয়ার সুখ্যাতি ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছে। সুবিন্যস্ত সিলেবাসের ভিত্তিতে, পর্যায়ক্রমে মৌলিকভাবে কুরআন, হাদীস, ফিকহ, তাফসীর, উসুল, আকায়িদ, বৈষয়িক পর্যায়ে আরবি সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য, ব্যাকরণ,নাহু, সরফ, বালাগাতসহ বাংলা, ইংরেজী, গণিত, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ভূগোল, দর্শন ইত্যাদি সমুদয় বিষয় প্রয়োজন পরিমাণ শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষার পাশাপাশি জনসমাজে ইসলামি শিক্ষার সুফল পৌঁছে দেওয়ার মহান লক্ষে জামিয়া বিভিন্ন সময় নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। সব মিলিয়ে জামিয়া ইসলামিয়া হামিদিয়া আহলিয়া বটগ্রাম বহু বিভাগ সমন্বিত একটি মহাপ্রকল্প।

জামিয়ার শিক্ষা প্রকল্প-

১. নূরানী মক্তব /বিভাগ:

এ বিভাগে মাত্র দু’বছরে সহিহ-শুদ্ধভাবে সম্পূর্ণ কুরআন শরিফ তেলাওয়াত, আমপারা ও অর্থসহ ৪০টি হাদিস মুখস্থ করানো হয়। অত্যাবশ্যকীয় মাসআলা-মাসায়েলসহ প্রাথমিক বাংলা, অংক ও ইংরেজি শেখানো হয়।

২. নাযেরা বিভাগ :

নূরানী/মক্তবথেকে আসা ছোট ছোট শিশুদেরকে ৬মাস থেকে ১বছরে সম্পূর্ণ কুরআন শরিফ বিশুদ্ধরূপে নাযেরা শিখানো হয়। সাথে সাথে আন্তর্জাতিক মানের লাহান ও তিলাওয়াতের যাবতিয় তাজবিদ শিক্ষা দান করে হিফজ উপযোগী করে তোলা হয়।

৩.হিফজ বিভাগ:

নাজেরা সমাপন করে আসা ছেলেদেরকে সুবিজ্ঞ শিক্ষকদের অধিনে রেখে, দেশবরেণ্য বিখ্যাত কারিদের তত্ত্বাবধানে ৩-৪ বছরে সম্পূর্ণ কুরআন শরিফ শুদ্ধরূপে মুখস্ত করানো হয়। আন্তর্জাতিক মানের কারীদের অনলাইন মশকের মাধ্যমে, বিশ্বমানের হাফেজে কুরআন হিসাবে গড়ে তোলা হয় ও হিফজ সমাপনকারী ছাত্রদের কিতাব বিভাগে ভর্তির জন্য বিশেষ কোচিং-এর মাধ্যমে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হয়।

৪. কিতাব বিভাগ:

এটি জামিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সর্বাধিক সমৃদ্ধ, বৃহত্তর ও প্রধান বিভাগ। মূলত এ বিভাগেই তৈরি হয় জাতির কাজারি, যোগ্য আলেমেদীন । দীনি শিক্ষার ক্রমমূল্যায়নের ভিত্তিতে কিতাব বিভাগটি মৌলিক পর্যায়ে পাঁচটি স্তরে বিভক্ত ইবতিদাইয়্যাহ(প্রাথমিক), মুতাওয়াসসিতাহ (মাধ্যমিক), সানাবিয়্যাহ (উচ্চ মাধ্যমিক), ফজিলত (ডিগ্রি) ও তাকমীল (মাস্টার্স)। এ পাঁচটি স্তরে মোট ১০ বছর সময়ে পূর্ণ মান শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীকে যোগ্য আলেমরূপে গড়ে তোলা হয়।

জামিয়ার ছাত্র প্রশিক্ষণ কর্মসূচী-

দ্বীন ও সমাজের সকল পরিসরে জামিয়ার সন্তানরা যাতে ভূমিকা রাখতে পারে, সেজন্য

রয়েছে নানামুখী আয়োজন। যথা-

ক. আল-হামীদ দারুল মুতালাআ (পাঠাগার) : পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি ছাত্রদের জ্ঞানের পরিধি আন্তর্জাতিকমানে উন্নয়নের লক্ষ্যে, সমকালীন অবস্থা ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগতির জন্য তথ্যবহুল বই-পুস্তকসমৃদ্ধ একটি পাঠাগার রয়েছে।

খ. বক্তৃতা প্রশিক্ষণঃ ইলম অর্জনের পর তা সুন্দর সাবলীলভাবে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে জামিয়ার আসাতিযায়ে কেরাম আয়োজন করে থাকে প্রতিযোগিতামূলক সাপ্তাহিক প্রশিক্ষণ মূলক বক্তৃতা সেমিনার।

গ. দেয়ালিকা: পাশ্চাত্যমুখী বিকৃত রুচির কলম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে, ইসলামি সাহিত্যে ও নির্মল জ্যোতি বিকিরণের মহান লক্ষ্য নিয়ে ছাত্রদেরকে কলম সৈনিকরূপে গড়ে তোলার জন্য বাংলা ও আরবী দেয়ালিকা প্রকাশ করা হয়ে থাকে ।

জামিয়ার সেবাপ্রকল্প-

১. ফতওয়া বিভাগ: ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও বিভিন্ন ধরণের উদ্ভূত জটিল সমস্যার সমাধানে দক্ষ মুফতী সাহেবগণ এ বিভাগ থেকে বিনিময়হীন শ্রম দিয়ে থাকেন।

২. ফারায়েজ বিভাগ: এ বিভাগ থেকে মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ওয়ারিশদের মধ্যে শরিয়তের বিধান মোতাবেক সুষ্ঠু বণ্টনের রূপরেখা প্রদান করা হয় ।

৩. দাওয়াত ও তাবলিগ : সাধারণ মানুষকে দীনের দাওয়াত ও তাদেরকে দীন শেখানো এবং নিজের আমলি জিন্দেগি গড়ার লক্ষ্যে ছাত্ররা প্রতি ছুটিতে সময় লাগানোর জন্য বের হয় । প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত ২৪ ঘন্টা তাবলিগি কর্মসূচি যথাযথ বাস্তবায়ন করে থাকে।

জামিয়ার শিক্ষা সফলতা-

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করার ফলে অতি অল্পসময়ে এ প্রতিষ্ঠানটির সুনাম-সুখ্যাতি বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় এ প্রতিষ্ঠানটি উলামায়ে কেরাম ও সুধী মহলের নিকট ব্যাপকভাবে সমাদৃত। অপর দিকে সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পরীক্ষাসমূহে বিভিন্ন মারহালায় (স্তরে) মেধা তালিকায় শীর্ষতম ও সম্মানজনক স্থান অধিকার করে ধারাবাহিক সাফল্য অর্জন করে আসছে।

শেষকথা-

মনোরম আবাসিক পরিবেশে, কুতুবুল আলম আল্লামা আব্দুল হামীদ রহ. এর দোয়ায়, অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় পরিচালিত এ জামিয়া সাবলীল গতিতে এগিয়ে চলছে তার অভীষ্ট লক্ষ্যপানে । দেশ, জাতি ও দীনের কল্যাণে জামিয়া হামিদিয়ার কর্মকাণ্ড হোক আরও গতিময় ও সাফল্যমণ্ডিত। আমীন!

 

শেয়ার করুনঃ