Botogram Madrasha

   

আল জামিয়া আল ইসলামিয়া হামীদিয়া কামিয়াহ বটগ্রামের প্রতিষ্ঠাতার সংক্ষিপ্ত জীবনী

১৮৮২ সনে কুমিল্লা জিলার একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বটগ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। শিশুকালে তিনি মক্তবে জালাল উদ্দীন নামের একজন মাওলানা সাহেবের নিকট প্রাথমিক লেখা- পড়া আরম্ভ করেন।

শিশু অবস্থায় মাও: আবদুল হামীদ রহ: এতিম হওয়ার ঘটনা। শিশু আবদুল হামীদ প্রাথমিক লেখাপড়া করা অবস্থায় একদিন তাঁহার সম্মানীত আব্বাজান গুয়াগাজী বাজারে যান বাজারের পার্শ্বে একটি হাতির ছানা দেখতে পান, যাহা ছিল সাহেব বাড়ির পালিত হাতির একটি ছানা। অদূরেই ইহার মা হাতিটি চরতে ছিল। তিনি আদর করে হাতির ছানাটির দেহে হাত দিলেন এখন চানাটি আওয়াজ করে উঠলে। সাথে সাথে বড় হাতিটি এসে তাঁহাকে নিজ দূরে উঠাইয়া মাটিতে আঘাত করল, ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন। ফলে শিশু আবদুল হামীদ তাঁহার ১জন বড় ভাই মো: আম্বর আলী ও একজন ছোট ভাই শুজাত আলী ও একজন ছোট বোন সহ চারজন এতিম হয়ে পরেন। অতপর সাহেব বাড়ির লোকজন বড় ভাই আম্বর আলীকে জীবিকা অর্জনের জন্য নিজেদের বাড়িতে একটি চাকরীর ব্যবস্থা করেন, আর তাঁহাদের আম্মাজান নিজ গ্রামের হাজী বাড়ি নিবাসী হাজী আহমদ আলী সাহেবের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

আবদুল হামীদ সাহেব শিশুকাল থেকেই অত্যন্ত মেধা সম্পন্ন ও পড়া-লেখার প্রতি খুব মনোযোগী ছিলেন এতিম হওয়ায় তাঁহাকে লেখা-পড়া থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি, সুনামের সাথে তিনি মক্তবের লেখাপড়া শেষ করেন। লেখাপড়ার প্রতি অনুরাগ ও মনোযোগী হওয়ার কারণে তিনি আরও উচ্চ শিক্ষার জন্য তখনকার একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। যাহা চৌয়ারা বাজারের দক্ষিণ উত্তর পাড়ে অবস্থিত ছিল। খুন্দারকরা নিবাসী আবদুল গফুর সাহেবের বাড়িতে তাঁহার জাগীরের ব্যবস্থা হল। অদমনীয় স্পৃহা ও আল্লাহ তাআলার প্রদত্ত মেধার মাধ্যমে কিছু দিনের মধ্যেই তাঁহার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। শিক্ষকগণের নিকট স্নেহের পাত্র ও ছাত্রদের নিকটশ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠলেন। এভাবে তিনি কিছু দিন অধ্যয়নের পর পরবর্তী শ্রেণি সমূহে আরও উন্নত অধ্যয়নের জন্য আরও উচ্চ ও উন্নত মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার প্রতি আগ্রহী হন। তবে উক্ত মাদরাসার শিক্ষক মন্ডলী ও তাঁহার বিশিষ্ট ওস্তাদ উক্ত মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাও: একামত আলী সাহেব উক্ত মাদরাসা থেকে তাঁহার স্থানান্তরিত হওয়ার উপর রাজী ছিলেন না। একদিন তিনি তাঁহার আম্মাজানের নিকট নিজের আগ্রহের বিষয়টি প্রকাশ করেন এবং ইহার প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ তাঁহার ওস্তাদের বিষয়টির ও আলোচনা করেন। তাঁহার আম্মাজান তাঁহার ওস্তাদকে নিজ বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে আনার জন্য বললেন। আমন্ত্রণ পাইয়া স্বযত্নে তিনি তাঁহার বাড়িতে আসলেন, সম্মানজনক আপ্যায়ন ও সৌজন্য আচরণ দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, অতপর তাঁহার ছেলের আগ্রহ ও নিজ আশা আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করলেন। এবার ওস্তাদ অনুমতি দিলেন। অনুমতি নিয়ে তিনি ভর্তি হন কুমিল্লা শহরের মোগলটুলী এলাকায় তখনকার অবস্থিত একটি মাদ্রাসায়। উক্ত মাদ্রাসায় কয়েক বৎসর যাবৎ অধ্যায়ন করে শেষ জমাত থেকে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি চলে যান চট্টগ্রাম শহরের হালিশহর এলাকায় অবস্থিত তখনকার একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে দূবৎসর যাবত অধ্যয়ন করেন। অতপর উচ্চ ডিগ্রী অর্জন করার জন্য বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দে উপস্থিত হন।

 

সেখানে ভর্তি হয়ে একাগ্রচিত্তে অধ্যয়ন করতে থাকেন। একাধারে ছয় বৎসর যাবত অধ্যয়নে রত ছিলেন, এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বাড়িতে আসা হয় নাই। তবে মাত্র একবার মাদ্রাসার কাজে আসিয়াছিলেন। সেখানেও অধ্যয়নের মাধ্যমে সম্মানিত ওস্তাদগণের অন্তরে অত্যন্ত মেধাবী হিসাবে স্থান করে নেন। যার প্রমাণ সেখানের একজন উচ্চস্তরের হাদীছের ওস্তাদের বাণী থেকে বুঝা যায়। এই উপলক্ষে একটি ঘটনার বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হল- টঙ্গীরপার নিবাসী জনাব মাও: আখতারুজ্জামান সাহেব বর্ণনা করেন। আবদুল হামীদ (রহ:) এর প্রতিষ্ঠিত বটগ্রাম মাদ্রাসাটি যখন সরকারি সিলেবাস অনুযায়ী চলতেছিল তখন তিনি উক্ত মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাশ করেন। তখন কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা ব্যতীত কামেল মাদ্রাসা শুধুমাত্র একটি ছিল। আর ইহা হল সিলেট আলীয়া মাদ্রাসা, তাও ছিল আসন সীমিত। প্রথম বিভাগের একশতজন ছাত্র ভর্তি করা হত। আমি উক্ত মাদ্রাসায় কামেল পড়ার জন্য উপস্থিত হইলাম। উক্ত মাদ্রাসার প্রধান মুহাদ্দীছ ছিলেন হযরত মাও: ছহুল সাহেব। তিনি মূলত দারুল উলুম দেওবন্দের হাদীসের উস্তাদ শায়খুল হাদীছ আল্লামা মাদানী (রহ:) এর সুপারিশে কিছুদিনের জন্য সিলেট আলীয়া মাদ্রাসার প্রধান মুহাদ্দীছের দ্বায়িত্ব পালন করেন। একদিন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাড়ি কোথায়, উত্তরে আমি বললাম কুমিল্লা জেলায়। উত্তর শুনে তিনি চমকে উঠলেন ও বলতে লাগলেন- “কাল বর্ণের আব্দুল হামীদকে চেন? সে আমার ছাত্র দেওবন্দের সে শ্রেষ্ঠ মেধাবী ছাত্র ছিল।“ তখন আমি বুঝতে পারলাম যে তিনি কি ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যে দীর্ঘ যুগ অতিবাহিত হওয়ার পরও তাঁহার ওস্তাদ এত অধিক ছাত্রের মাঝে তাঁহার সুনাম এইভাবে উল্লেখ করেন।

দারুল উলুম থেকে ফারেগ হওয়া ও হযরত থানবী (রহ:) এর সংস্রবে থাকা। ছয় বৎসর যাবৎ দারুল উলুম দেওবন্দে অধ্যয়নরত থাকিয়া সেখান থেকে ফারেগ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। সেখান থেকে থানাভন চলে যান মুজাদ্দেদে মিল্লাত হাকীমুল উম্মাত আল্লামা থানবী (রহ:) এর দরবারে। আত্মশুদ্ধী ও এলমে বাতেন অর্জন করার জন্য একাধারে ছয় মাস যাবত সেখানে অবস্থান করেন। ইতমধ্যে তিনি স্বপ্নে দেখেন যে তাহার বাড়ির সামনে একটি বৃক্ষ, যার তলদেশে আছে একটি পুকুর, যা দ্বারা বহুলোক উপকৃত হইতেছে। কেহ গোসল করতেছে, কেহ ওযু করতেছে, কেহ পানি পান করতেছে। তিনি উক্ত স্বপ্ন থানবী (রহ:) এর নিকট বর্ণনা করলেন, থানবী (রহ:) বললেন যে তোমার বাড়িতে একটি মাদ্রাসা হবে। যাহার প্রচার দুর দুরান্তে ছড়িয়ে পড়বে। কয়েকদিনের মধ্যে তাহার আম্মাজানের পক্ষ থেকে একটি চিঠি পাইলেন। যার মধ্যে তাঁহার আম্মাজান বাড়ীতে আসার নির্দেশ দেন। চিঠি নিয়ে থানবী (রহ:) এর নিকট যান। থানবী (রহ:) তাহাকে বাড়ীতে আসার অনুমতি দেন ও বলেন যে বাড়িতে গিয়ে দীনের খেদমত করিবে। অনুমতি পেয়ে তাহার আম্মাজানের আদেশ পালনার্থে বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা করেন। বাড়িতে ফিরিয়া আসার পূর্বে তাহার মামাজানের (মনু মিঞা সা:) নিকট চিঠি লিখেন যে তিনি বাড়িতে আসলে ওমক ওমক জমিন বিক্রি বা দানের মাধ্যমে তাঁহার মালিকানায় ছেড়ে দিতে হবে (যে জমিনের উপর বর্তমানে তাঁর বাড়ী অবস্থিত) তাঁহার মামাজান সম্মতি জ্ঞাপন করেন। তখন তিনি বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে প্রত্যাবর্তন করে প্রথমে নিজ আম্মাজানের নিকট পশ্চিম বটগ্রাম হাজী বাড়ীতে অবস্থান করেন নিজ বাড়ি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে বাড়িতে অবস্থান করতে থাকেন। মসজিদের দক্ষিণে অবস্থিত পুকুরটি তাঁহার মামাজানের ছিল। তার চতুর্দিক থেকে বর্ষার। সময় কাদা এসে ভরাট হয়ে যায়। আ: হামীদ (রহ:) আরও তিনজন শরিক গ্রহণ করে মোট ৪জন। ইহা ক্রয় করে পুনরায় পুকুর খনন করেন।

তখন সামাজিক অবস্থা ছিল খুবই মন্দ। শান্তি শৃংখলা বলতে কিছুই ছিলনা। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য ছিলনা, সামান্য বিষয়েও মারামারী এমনকি ঘুমাধুনী হত, ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকত, অন্যায়, অত্যাচার ও শোষনের রাজত্ব চলছিল। শিক্ষা-দিক্ষার ব্যবস্থা ছিলনা, শিরক, বিদ আত ও বিভিন্ন প্রথা প্রচলিত ছিল। সঠিক নামাজ ছিল না। ইসলামী নিয়ম কানুন অজানা ছিল। এই প্রতিকূল পরিবেশে আল্লাহ তালার রহমতের উপর ভরসা করে তিনি একাই মাদ্রাসা নির্মানের কাজ আরম্ভ করেন। প্রথমে ১৯০৮ইং সনে নিজ বাড়ীর আঙ্গিনার দক্ষিণ পার্শ্বে উত্তরমুখী করে পূর্ব পশ্চিমে লম্বা করে একটি টিনের ঘর নির্মাণ করেন ও নিজেই প্রত্যেক শ্রেণির পড়ানোর দ্বায়িত্ব পালন করেন। তারপর ছাত্র সংখ্যার বৃদ্ধির কারণে পুকুরের পাড়ে পশ্চিম মুখী করে উত্তরে-দক্ষিণে তর্জার বেড়া দ্বারা ২য় ঘর নির্মাণ করেন। ক্রমে ছাত্র সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাইতে থাকে। নির্মিত ২টি ঘর ছাত্রদের ধারণ ক্ষমতার বাহিরে হয়ে যাওয়ায় পশ্চিমাংশে পূর্ব মুখী করে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা করে দীর্ঘ আয়তনের মাটির ঘর নির্মাণ করা হয়। প্রথমাবস্থায় তিনি একাই প্রত্যেক শ্রেণির পাঠদানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন কিছুদিন পর নলছোঁয়া নিবাসী মাও: ইজ্জাত উল্যাহ সাহেবকেও সহকারি হিসাবে নিয়োগ দেন। আরও কিছুদিন পর যুক্তিখোলা নিবাসী মাও: আ: আজীজ সাহেবকেও নিয়োগ দেন। হযরত আ: হামীদ (রহ:) পড়া লেখার সাথে সাথে ছাত্রদের আমল-আখলাক আচার-আচরণের প্রতিও গুরুত্ব দিতেন। কিছুদিনের মধ্যেই মাদ্রাসার সুনাম দুর-দুরান্তে ছড়িয়ে পরে। তখন ছাত্রদের বোর্ডিংয়ে থাকার কোনো নিয়ম ছিলনা। তাই দুর দুরন্ত থেকে আগত ছাত্রদের থাকা খাওয়ার জন্য জাগীরের ব্যবস্থা করা হত। ছাত্র সংখ্যার আধিকের কারণে এলাকার বাহিরে দুর এলাকায়ও ছাত্রদের জাগীর থাকতে হত। প্রতিদিন সকাল বেলায় ছাত্রদের মাদ্রাসায় আসার সময় ও বিকাল বেলায় ছুটির পর জাগীরে যাওয়ার সময় চতুর্দিকে রাস্তায় ছাত্রদের ভীর দেখা যাইত। তার সাথে সাথে ছাত্রদের চালচলা আচার আচরণ দেখে এলাকার লোকজন খুবই অবিভূত হইত। ক্রমে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি হইতে থাকে, সাথে সাথে শ্রেণী সংখ্যা বাড়তে থাকে, তাই আরও শিক্ষক নিয়োগ দিতে হয়। শিক্ষকগণের মাসিক হাদিয়ার পরিমান বৃদ্ধি হইতে থাকে। তিনি একাই শিক্ষকগণের হাদিয়ার ব্যবস্থা করতেন। এই জন্য তিনি অনেক সময় বিভিন্ন স্থানে ছফর করতেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি তখন যানবাহন হিসাবে এটি ঘোড়া রাখতেন। সাথে একজন শিক্ষক নিয়ে যাইতেন। কোনও স্থানে গিয়ে তিনি কয়েকদিন থাকতেন। লোকজন মাদ্রাসার জন্য কালেকশান করে তাঁহার হাতে দিতেন। তিনি ইহা নিয়া মাদ্রাসায় ফিরিয়া আসিতেন। নমুনা স্বরূপ ১টি ঘটনার বিবরণ নিম্নে দেওয়া হইল। মাও: আবদুল আজীজ (রহ:) বলেন যে একবার আমি আব্বাজানের সাথে গেলাম। সেখানে গিয়ে একটি বাড়ীতে মেহমান হিসাবে অবস্থান করলাম বাড়ীর মালিক এক সময় আমাকে জিজ্ঞাস করল আপনি কি হুজুরের ছেলে? উত্তরে বললাম হ্যাঁ আমি হুজুরের ছেলে। লোকটি বলল আল্লাহ তাআলা হুজুরের উছিলায় শান্তিতে রেখেছেন। আমি বললাম হুযুরের উছিলায় কিভাবে? উত্তরে বলল, ছোট বেলা থেকে আমার চুরি করার অভ্যাস ছিল। না বুঝে চুরি করিয়া লাঞ্চিত জীবন যাপন করতাম। এক সময় হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করে এই বিষয়টি হুজুরের নিকট জানাই। হুজুর বললেন তোমার কি কোনো সম্পদ আছে? বললাম আমার একটি কোদাল আছে। হুজুর বললেন যাও আজ থেকে আর চুরি করিবে না। এই কোদাল দ্বারা মাটি কাটিয়া হালাল অর্থ উপার্জন কর। হুজুরের উপদেশ অনুযায়ী তাই করতে আরম্ভ করি। আল্লাহর রহমতে হুজুরের দোয়ায় বর্তমানে হালাল উপার্জন করে শান্তির জীবন-যাপন করিতেছি। এই জাতীয় অনেক ঘটনা থেকে একটি বর্ণনা করা হলো। এতে তাঁহার অক্লান্ত পরিশ্রম ও লোকজনের দ্বীনি ও দুনিয়াবী উপকার পৌঁছানের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

ক্রমে মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে থাকে। এভাবে মাদ্রাসার সুখ্যাতী চতুর্দিকে ছড়িয়ে পরে। বাটি দেওবন্দী আকীদায় দ্বীনের প্রচার প্রসার ও শিরক বিদআত নিশ্চিহ্ন করে আসতে। থাকে। এতে এলাকা থেকে শিরক বিদআত দূরীভূত হয়ে দ্বীনি পরিবেশ ও সুন্নতে নববীর একটি নমুনা সৃষ্টি হয়। এভাবে চব্বিশ বৎসর পর্যন্ত মাদ্রাসা চলতে থাকে চব্বিশ বৎসর পর শিক্ষকদের মধ্যে কোনো কোনো শিক্ষক মাদ্রাসাটিকে সরকারী মাদ্রাসায় পরিণত করার প্রতি ঝুঁকিয়া পরে।। তাহারা বিভিন্ন যুক্তি দ্বারা সরকারী মাদ্রাসার পরিনত হওয়ার বিভিন্ন সুবিধার দিক তুলে ধরেও বেসরকারী থাকিলে বিভিন্ন ক্ষতি ও সমস্যার দিক তুলে ধরে। সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা মাও: আব্দুল হামীদ সাহেব (রহ:) এর নিকট বলল যে হুযুর মাদ্রাসা সরকারী হলে সরকারই মাদ্রাসার যাবতীয় ব্যয় ভার বহন করবে। অর্থের জন্য আমাদেরকে দুয়ারে দুয়ারে ফিরতে হবে না। চাঁদার উপর নির্ভর করে মাদ্রাসা চলতে পারে না। এতে শিক্ষকগণ অভাবগ্রস্ত হবেন। টাকা-পয়সা ছাড়া ঈমান আমল ঠিক রাখা কঠিন। শিক্ষকগণ চাঁদার জন্য সময় ব্যয় করতে হয়। তবে মাদ্রাসা সরকারী হলে শিক্ষকগণ শুধু লেখা-পড়া করাবেন। পরীক্ষার ফলাফল ভাল করার জন্য প্রতিযোগিতামূলক লেখা-পড়া করাবেন। এতে লেখা-পড়ার মান উন্নত হবে।

জনাব মাও: আবদুল হামীদ (রহ:) তাহাদের উক্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তিনি বললেন যে সরকারী মাদ্রাসা ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত, ইসলাম ও মুসলমানদের উপকার করার জন্য কখনো ইহা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই বরং মুসলমানগণের ক্ষতি করার জন্যই ইহার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। যদিও বর্তমানে তাহারা ইহাতে ধর্মের রং দিয়েছে তবে এই রং একদিন থাকবে না। অতএব মাদ্রাসা সরকারীতে পরিণত করার পরিনতি শুভ হবে না। কিন্তু বিপক্ষের শিক্ষকগণ ইহা মানতে পারল না, বরং তারা তাহার বিরোধিতায় স্থির রহিল ও বলল, যে হুযুর কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ আমাদের মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকাও কিতাবাদি এবং সরকারি মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকা ও কিতাবাদি তো একই আছে। কোরআন ও হাদীছের কিতাবও একই তাই সরকারীতে পরিণত হলে পার্থক্য কিছুই হবে না। শুধু কিছু বাংলা ইংরেজি পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভূক্ত করা হবে। বর্তমানে দুনিয়ায় চলতে হলে বাংলা ইংরেজির প্রয়োজন আছে। সরকারি মাদ্রাসায় পরিণত হইলে চাঁদার কোনো ঝামিলা থাকবে না। তখন শিক্ষকগণ পড়া-লেখার প্রতি মনোযোগী হইতে পারবে। আবার মাদ্রাসা সরকারী করার জন্য আপনি কোনো প্রকারের ঝামেলায় পরতে হবে না। আপনি শুধু রাজী থাকবেন যাহা কিছু করতে হবে সবকিছু আমরাই করে নিব। অতপর তিনি তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। অতপর তাহারা মাদ্রাসা সরকারীতে পরিণত করার তদবীর চালায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে একদিন মাদ্রাসা পরিদর্শনের জন্য ইনেস্পেক্ট্রার আসে। সর্বপ্রথম হযরতের সাথে সাক্ষাত হয়। তাহাকে দেখেই বলে উঠল যে আপনি বেহেস্তি মানুষ। অতপর অফিস রুমে সামান্য আলোচনার পর হযরতের নিকট বলল যে আপনার মাদ্রাসার সরকারী মজুরী দেওয়া হবে। অতপর ১৯৩২ ইং সনে যখন মাদ্রাসা হযরতের বাড়ীর আঙ্গীনায় ছিল, তখনই মাদ্রাসাটি সরকারি মাদ্রাসায় পরিনত হয়। তখন সরকারি মাদ্রাসার পাঠ্যতালিকা ও কওমী মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকা একইছিল শুধু ইংরেজি বাংলা বৃদ্ধি করা হল ও মাদ্রাসা সরকারী হিসাবে চলতে লাগল। মাদ্রাসা সরকারী চলাকালীন ও পূর্বের ন্যায় লেখা-পড়া ভালই চলতেছিল। তাই প্রকাশ্য দৃষ্টিতে মাদ্রাসার অবস্থা পূর্বের মতই মনে করা হত, তবে পূর্বে ছাত্র-শিক্ষকগণের যেই তাকওয়া, খোদাভিত্তি ও সুন্নতে রাসূলের যেই গুরুত্ব ছিল, যেই উদ্দেশ্যে মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল, ক্রমে ইহার অভাব ধরা পড়তে লাগল বিভিন্ন ওলামায়ে কেরামের নিকট বিশেষ করে প্রতিষ্ঠাতা জনাব মাও: আ: হামীদ (রহ:)এর নিকট। তিনি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে চিন্তা করতে লাগলেন, তাহার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের প্রতিও বর্তমান অবস্থার প্রতি।

 

অবশেষে তিনি মাদ্রাসাকে পুনরায় কাওমীতে পরিণত করার ইচ্ছা করেন। এমতাবস্থায় একদিন বোর্ডের পরীক্ষা চলাকালীন তিনি প্রয়োজনে বাথরুমে যান। গিয়ে সেখানে তাফসীর ও হাদীসের বানীর পাতা পড়িয়া আছে দেখতে পান। বাহিরে আসিয়া তিনি কয়েজাকনকে ই দেখান ও অত্যান্ত মর্মাহত হন। অতপর তিনি ঘোষণা করেদেন যে, আর মাদ্রাসা সরকারী রাখা যাবে না। কাওমী মাদ্রাসাই আবার চালু হবে। অতঃপর মাও: আ: আজীজ (রহঃ) এর দায়িত্বে বাড়ীর আঙ্গীনায় কাওমী মাদ্রাসা চালু করেন ও বর্তমান মাদ্রাসার স্থানে উভয় বিল্ডিংএ সরকারী মাদ্রাসা চলতে থাকে । মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা জনাব মাও: আবদুল হামীদ সাহেব (রহ:) প্রথমে কিছুদিন উভয় মাদ্রাসায় দূরসদান করতেন। পরে শুধু বাড়ীর আঙ্গিনার কাওমী মাদ্রাসাই দরস দান সিমিত করে দেন। এইভাবে কিছুদিন চলতে থাকে। এই অবস্থায় একদিন পক্ষের একজন লোক হাজী আ: গনী সাহেব (রহ:) হযরতের নিকট গিয়ে বলেন যে ইহা কেমন করে হতে পারে যে আপনি মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হয়ে বাড়ীতে থাকবেন আর অন্য ব্যক্তিরা মাদ্রাসায় থাকবে। আসুন আপনি পশ্চিম ভিটির মাদ্রাসায় বসুন আর সরকারী মাদ্রাসা উত্তর ভিটির ঘরে চলবে। এই বলিয়া হযরতের হাতে ধরে তাঁহাকে মাদ্রাসায় আনিয়া বসাইয়া দেন। তখন থেকে মাদ্রাসায় উশৃংখলা আরম্ভ হয় তখন সরকারী মাদ্রাসার পক্ষ থেকে প্রিন্সিপাল হযরতের বিপক্ষে আদালতে একটি মামলা দায়ের করে ও ফৌজদারীতে অপর একটি মামলা দায়ের করে। অপর একটি মামলা সরকারি মাদ্রাসার অন্যান্যদের পক্ষ থেকে হযরতের বিরুদ্ধে মোট তিনটি মামলা দায়ের করা হয় ও তাঁহার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী করা হয়। পুলিশ তাহাকে গ্রেপ্তার করার জন্য বহুবার মাদ্রাসায় ও তাহার বাড়ীতে এসে তল্লাশি করে কিন্তু মামলা চলার তিন বৎসরের মধ্যে কখনো গ্রেপ্তার করতে পারে নাই। কোনো সময় তাহাকে দেখে ছালাম দিয়ে দেখা সাক্ষাত করে চলে যাইত কখনো তাহাকে না খুঁজে চলে যাইত। সর্বশেষ এক বারের ঘটনা, পুলিশ তাহার নিকট আসিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাস করল যে, মাও: আ: হামীদ কে? উত্তরে তিনি বললেন “আমি”। পুলিশ তাহাকে বললেন সরকারের আদেশ আপনাকে হেন্ডকাপ পড়িয়ে কোর্টে হাজির করার তিনি বললেন “পড়াও” তাহারা এগিয়ে তাহার নিকট গেল তৎক্ষনাৎ ভয়ে আক্রান্ত হল। হেন্ডকাপ পড়াইতে অক্ষম হয়ে পরল, হযরত বললেন, হেডকাপ পড়াইতে হবে না। আমি এমনেই যাব। এবার তিনিও পুলিশ এক সাথে চললেন, গুয়াগাজী বাজার পর্যন্ত পৌঁছার পর তাহারা গাড়ী খোজ করতে লাগল। গাঁড়ি পাওয়া গেলনা। হযরত বললেন গাড়ী ছাড়াই চল। তাহারা বলল হেঁটে গেলে অফিসের সময় চলে যাবে। তিনি বললেন অফিসের সময় যাবেনা। হযরত ছোট ছোট কদম দিয়ে চলতে লাগলেন। সময়মত কুমিল্লা কোর্টে পৌঁছে গেলেন। কোর্টে জজ সাহেব হুজুরকে দেখে সালাম নিল ও পুলিশদেরকে জিজ্ঞাস করল হুজুরকে কষ্ট দেও নাইত, তাহারা বলল না কষ্ট দেই নাই। অতপর হযরতকে চেয়ারে বসার জন্য বলল ও বলল যে হুজুরের মামলার ফাইলটি আন, অতপর মামলা খারিজ করিয়া দিল ও হযরতকে সসম্মানে বিদাই দিল। আদালতে মামলার বাবতে রায় হল যে, জন সম্মুখে মাদ্রাসা সরকারী চলবে নাকি কাওমী চলবে এই বাবতে সিদ্ধান্ত হবে। এই উদ্দেশ্যে একটি সভার আয়োজন করা হল। কাওমী মাদ্রাসার পক্ষ থেকে দেশ বিদেশের প্রক্ষাত ওলামায়ে কেরামগণকে আমন্ত্রণ করা হল (১) হযরত মাও: সুলতান সাহেব পীরে কামেল নানুপুর (চট্টগ্রাম), পীরে কামেল মাও: দেলোয়ার হুছাইন সাহেব ফেনুয়া, লাকসাম, হযরত মাও: কোরবান আলী সাহেব বাগমারা। হযরত মাও: ইয়াছিন সাহেব মুহতামেম বরুড়া মাদ্রাসা, তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী আশ্রাফ উদ্দীন চৌধুরী, সরকারী পক্ষে মাও: মুছলেহ উদ্দীন পীরে কামেল মাহি হাতা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া। এমনকি দারোগা সভার দিন প্যান্ডেল করার জন্য মাদ্রাসার মাঠ ব্যবহার করতে অনুমতি হল না। তাই মাদ্রাসার পূর্বদিকের জমি যেখানে বর্তমানে মাদ্রাসার পুকুর অবস্থিত, সেখানে প্যান্ডেল করা হল। কাওমি মাদ্রাসার পক্ষ থেকে প্রথমে বক্তব্য পেশ করেন মাও: কোরবান আলী সাহেব। অত:পর সরকারী মাদ্রাসার পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন মাছিহাতার পীর সাহেব। অতপর কাওমী মাদ্রাসার পক্ষ থেকে নানুপুরের পীর সাহেব কাওমী মাদ্রাসার উপকারিতা ও সরকারী মাদ্রাসার ক্ষতির দিক সমূহ জনসমক্ষে তুলে ধরলে সভাস্থলের প্রায় সকলেই কাওমী মাদ্রাসার পক্ষে সমর্থন দিলেন। অতপর জনমত জরীপ করা হল প্রায় সকলেই কাওমী মাদ্রাসার পক্ষে ভোট দিল। অতপর এমপি সাহেব রায় ঘোষণা করলেন যে, আজ থেকে অত্র মাদ্রাসা একমাত্র কাওমী মাদ্রাসা হিসাবে চলবে। তবে তিনি হযরতকে একথাও বললেন যে, মাদ্রাসার উভয় বিল্ডিং সরকারী অর্থে নির্মিত তাই ইহা সরকারকে দিতে হবে। তিনি বললেন যে ঠিক আছে আপনার বিল্ডিং ভাঙ্গিয়া নিয়া যান পরে এমপি বললেন যে, মাদ্রাসার আসবাবপত্র সহ অন্যত্র মাদ্রাসা স্থানান্তরিত করলে আপনার কোনো আপত্তি আছে? তিনি বললেন যে কোনো আপত্তি নাই। অতপর অত্র মাদ্রাসার মঞ্জুরী স্থানান্তরিত করে পিপুলিয়া নেয়া হয়। বটগ্রাম কাওমী মাদ্রাসাটি দেওবন্দের নেসাবে ও দেওবন্দের তারীকা অনুযায়ী চাটাইর উপর বসে, তেপায়ার উপর কিতাব রেখে পড়ালেখা আরম্ভ হয়। এভাবে পুনরায় কাওমী মাদ্রাসা হিসাবে চলতে আরম্ভ করল। তখন তিনি তাঁহার ভক্ত বৃন্দকে মাদ্রাসার প্রতি দৃষ্টি রাখার কথা জানাইলেন। অতপর তিনি একদিন অত্যান্ত অসুস্থ হয়ে পরেন এই অসুস্থতাবস্থায়ই ২০/০৭/৭১বাংলা রোজ শুক্রবার বেলা ১০টার সময় এই দুনিয়া থেকে চির বিদায় নেন।